"ভালো মানুষ হতে চাও? কিন্তু কেনো? কার জন্য?"

ভালো মানুষ হওয়ার পথ – আত্মজিজ্ঞাসা ও জীবন উপলব্ধি নিয়ে একটি দর্শনভিত্তিক বাংলা ব্লগ পোস্ট
MyAstrology 

ভালো মানুষ হওয়া - আত্মজিজ্ঞাসার এক যাত্রা | Dr. Prodyut Acharya

ভালো মানুষ হওয়া - আত্মজিজ্ঞাসার এক যাত্রা

✍️ লেখক: Dr. Prodyut Acharya

ভালো মানুষ হওয়ার অর্থ কী?

ভালো মানুষ হওয়া—এই কথাটি শোনা যায় ছোটবেলা থেকে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছো, কাকে বলে ভালো মানুষ? তুমি কি সত্যিই নিজেকে ভালো মানুষ করতে চাও, নাকি কারো অপমান, অবহেলা, বা প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়ায় তুমি ‘ভালো’ হতে চাও? প্রশ্নগুলো সহজ হলেও উত্তর গভীর।

সাধারণত সমাজে যাদের ভালো মানুষ বলা হয়, তারা হল—সৎ, সত্যবাদী, নির্লোভ, পরোপকারী, নীতিবান, কখনো কারো ক্ষতি করেন না, এমন মানুষ। আবার, বাস্তবে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠিত, ধনী, ক্ষমতাশালী, পরিবারকেন্দ্রিক মানুষদের ‘ভালো’ বলা হয়—যদি না-ও তারা পুরোপুরি নীতিনিষ্ঠ হয়।

তাহলে প্রশ্ন জাগে—‘ভালো মানুষ’ হওয়া কি একটি নৈতিক আদর্শ, নাকি সমাজনির্ধারিত এক ছাঁচ, যেখানে সফলতা, প্রভাব এবং সামাজিক স্বীকৃতিই ভালো হওয়ার মাপকাঠি?

তুমি কেমন ভালো মানুষ হতে চাও?

এই প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন ভীষণ সৎ মানুষও সমাজে অপমানিত হতে পারে, যদি সে ‘সফল’ না হয়। জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তি বলেছিলেন:

"It is no measure of health to be well adjusted to a profoundly sick society."
—J. Krishnamurti

অর্থাৎ, যদি সমাজ নিজেই অসুস্থ হয়, তাহলে সেই সমাজের মাপকাঠিতে ‘ভালো’ হওয়া কখনো প্রকৃত ভালো মানুষ হওয়া নয়।

চেতনার জাগরণই আসল পথ

ভালো মানুষ হওয়ার চেয়ে বড়ো প্রশ্ন হলো—তুমি নিজেকে কতটা চিনতে পেরেছো? তুমি কি নিজের আবেগ, স্মৃতি, প্রতিক্রিয়া—এইসবের গভীর উৎস বুঝতে পারো? তুমি কি জানতে পেরেছো, তোমার কষ্ট আসলে অন্যের কথায় নয়, বরং তোমার নিজের স্মৃতির সঞ্চয়ে?

উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি তোমাকে ‘অযোগ্য’ বলে, এবং তুমি দুঃখ পাও, তাহলে সেটা শুধু তার কথার জন্য নয়—তোমার ভেতরের এক স্মৃতিতে সেই শব্দ আগে থেকেই মানে হয়ে বসে আছে। এই Matching এর ফলে কষ্ট জন্ম নেয়। সুতরাং, ব্যথা আসলে তোমার নিজের মন থেকেই আসে, বাইরের জগৎ শুধু trigger করে দেয় মাত্র।

স্মৃতি ও কল্পনার ফাঁদ থেকে মুক্ত হওয়া

আমরা যা কিছু অনুভব করি, তার অধিকাংশই স্মৃতি বা কল্পনার সঙ্গে যুক্ত। একটা ফুল দেখেই যদি তুমি আগের কোনো ফুলের সঙ্গে তুলনা করো, তাহলে বর্তমানের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতায় বলা হয়েছে:

"কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।"
অর্থাৎ, তোমার অধিকার আছে কেবল কর্মে, ফলে নয়।
—গীতা, অধ্যায় ২, শ্লোক ৪৭

তুমি এখন যে অবস্থায় আছো, যে ভূমিকা পালন করছো, সেটাই তোমার সত্য। গীতার ভাষায় যেমন অর্জুনকে বলা হয়—"তুমি এখন যোদ্ধা, অতএব যোদ্ধার মতো লড়াই করো।" ঠিক তেমনি, তুমি যখন ছাত্র, তখন ছাত্রের মতো হও; পুত্র হলে পুত্রের মতো, বন্ধুর কাছে বন্ধু।

নিজের ভিতরেই নিজের পথ

ভালো মানুষ হওয়া মানে অন্যের চোখে ভালো দেখানো নয়, নিজের চেতনার বিকাশ ঘটানো। সৎ হওয়া মানেই যথার্থ মানুষ হওয়া নয়, যদি তা লোক দেখানো হয়। মানুষকে জানতে হলে, আগে নিজেকে জানতে হয়। নিজের মন, চিন্তা, ইচ্ছা, কষ্ট—এই সব কিছুকে বোঝা এবং গ্রহণ করাই হলো আত্মউন্নয়নের প্রথম ধাপ।

ভালো হতে চাও কেন? নিজের না অন্যের কারণে?

অনেক সময় তুমি হঠাৎ করে অনুভব করো, "আমি ভালো মানুষ হতে চাই।" কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ইচ্ছা তোমার নিজের না কি বাইরের কেউ তোমাকে খারাপ বলেছে, উপেক্ষা করেছে, সেই যন্ত্রণা থেকে এই চাওয়া এসেছে? যদি তা-ই হয়, তাহলে এই চাওয়া তোমার নিজের নয়, একরকম প্রতিক্রিয়া মাত্র।

জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তি বলেছিলেন—"The moment you have a motive to be good, you are no longer good."
অর্থাৎ, যখন তুমি ‘ভালো’ হওয়ার জন্য কোনো উদ্দেশ্য রাখো (যেমন: প্রশংসা পাওয়া, স্বীকৃতি পাওয়া), তখনই তুমি প্রকৃত ভালো থাকো না।

ভালো হওয়ার একমাত্র পথ—নিজেকে সত্যভাবে জানা এবং চেতনার আলোয় নিজের কর্ম, মন, অভ্যাস ও বোধকে শুদ্ধ করে তোলা।

চেতনার গভীর উপলব্ধি: স্মৃতি, কল্পনা ও বর্তমান

মানুষ সাধারণত তিনটি জায়গায় বসবাস করে—অতীত (স্মৃতি), ভবিষ্যৎ (কল্পনা) এবং বর্তমান (বাস্তব)। কিন্তু সমস্যাটা হয় তখন, যখন স্মৃতি বা কল্পনার ভেতর ডুবে আমরা বর্তমানকে হারিয়ে ফেলি। যেমন কেউ তোমাকে একদিন অপমান করেছিল, তুমি সেই অপমানের স্মৃতি বয়ে চলেছো, ফলে তুমি নিজেকে বদলাতে চাও—ভালো হতে চাও। কিন্তু এই ‘ভালো’ হবার প্রেরণা জন্ম নিয়েছে ব্যথা থেকে, যা সর্বদা স্থায়ী নয়।

বাস্তবতা হলো, তুমি ঠিক এই মুহূর্তে যেটা করছো, সেটাই বাস্তব। যা ঘটে গেছে তা স্মৃতি, যা ঘটবে তা কল্পনা। এই দুটোকে দরকারমতো ব্যবহার করো, কিন্তু জীবনযাপন কেবল বর্তমানেই করো।

প্রতিটি মুহূর্তে নিজের কর্তব্যে স্থিত হওয়া

গীতার অন্যতম শিক্ষাই হলো ‘সময় ও ভূমিকা অনুসারে নিজের কর্তব্য পালন করা’। অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে দ্বিধান্বিত। তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেন:

"হে পার্থ, তুমি এখন যোদ্ধা—সুতরাং যোদ্ধার মতো কাজ করো।"
— গীতা, অধ্যায় ২

ঠিক তেমনি, তুমি যখন বন্ধুর সাথে, তখন বন্ধু হও; যখন কর্মক্ষেত্রে, তখন পেশাদার হও; যখন পরিবারে, তখন সন্তান/পিতা/ভাই হয়ে ওঠো। এই ভূমিকা-ভিত্তিক সচেতনতা এবং পূর্ণ উপস্থিতি—এটাই চেতনার চর্চা, এটাই সত্য ভালো মানুষ হওয়ার পথ।

নিজেকে চিনো, নিজের মতো করে গড়ে তোলো

একজন ভালো মানুষ হওয়ার জন্য দরকার নিজের অনুভব, যুক্তি, চেতনা, বিবেক, স্মৃতি, কল্পনা—সবকিছুকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা। তুমি যেমন নিজের স্মৃতিকে গঠন করো, তেমনি তুমি কল্পনার জগৎও তৈরি করো। কিন্তু এই দুইয়ে ডুবে গেলে তুমি হারিয়ে যাবে।

নিজের মনকে এক প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন—যাতে প্রতিক্রিয়ার বদলে ‘প্রতিক্রিয়াহীন বোধ’ তৈরি হয়। তখন তুমি বুঝতে পারবে, কে কী বলল তা বড়ো নয়—তুমি নিজের ভেতরে কতটা শান্ত, স্থির, এবং সচেতন তা-ই আসল।

এবং এই বুঝতে পারাটাই, ধীরে ধীরে, একজন প্রকৃত ভালো মানুষের জন্ম দেয়—যিনি নিজের আলোয় পথ চলে, অন্যের চোখে নয়।

উপসংহার: ভালো মানুষ হওয়া মানে নিজের গভীরে যাত্রা

সুতরাং, ভালো মানুষ হতে হলে প্রথমেই জানতে হবে—ভালো হওয়ার মানে কি? কার চোখে তুমি ভালো হতে চাইছো? কেন সেই চাওয়া এসেছে? যদি সত্যিই তুমি নিজের ভিতর থেকে নিজেকে ভালো করতে চাও, তবে শুরু করতে হবে আত্মজিজ্ঞাসা দিয়ে। আত্মজিজ্ঞাসা ছাড়া আত্মউন্নয়ন অসম্ভব।

‍জিদ্দু কৃষ্ণমূর্তির আরেকটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি:

“To understand yourself is the beginning of wisdom.”
— J. Krishnamurti

ভালো মানুষ হবার জন্য তোমাকে কেউ বলে দেবে না কী করো, কী না করো। বরং তুমি নিজেই নিজের পথ তৈরি করবে, নিজের বোধ, বিবেচনা, ও উপলব্ধির আলোয়।

✍️ লেখক: Dr. Prodyut Acharya

🌐 www.myastrology.in | 📞 +91 9333122768

📍 Ranaghat, Nadia, India

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মকর লগ্নের মানুষের স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য

ধনু লগ্নের মানুষের স্বভাব, চরিত্র, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট

মীন লগ্নের মানুষের সভাব, চরিত্র, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য